গণতন্ত্রের অভিযাত্রার ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্টরা বাধা দিবে এটা স্বাভাবিক উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, আমাদের ধৈর্য্যরেও কিছু ঘাটতি আছে। এতদিন একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন, ধৈর্য ধরেছেন। ১৬ বছর ধরে ধৈর্য ধরেছেন আর এখনো তো ১৬ সপ্তাহও হয়নি; ধৈর্য হারা হয়ে গেছেন! এখন দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ গত দেড় যুগে কি কি করেছে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। সবাই এখন সমন্বয়কদের সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের সমালোচনা করেন তবে তার সাথে অতীতের ইতিহাসও টানেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা, আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, আগে সারাদিন সমালোচনা করতাম আর মানুষ মাথায় করে নাচতো। আর এখন সারাদিন কাজ করি আর সবাই গালি দেয়। এখনো মনে হয় এই দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা কি আমার আছে! আমার মাঝেও অনেক অপূর্ণতা আছে। সবকিছু আমাদের একার দ্বারা সম্ভব নয়। সবাই খালি সমালোচনা করে, কিন্তু কেউই কোনো সমাধান দেয় না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপ্লবী সরকার ঘোষণা না করে সাংবিধানিক পথে আগানোর প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে হয়েছে মন্তব্য করে আইন উপদেষ্টা বলেন, সাংবিধানিক পথে যাত্রা সবগুলো রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। সবাই মিলে সাংবিধানিক পথে যাত্রা শুরু করেছিল যাদের প্রত্যেকটি দল এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। গণতন্ত্র যাত্রার বিশাল টেবিলের এককোনায় বসেছিলাম আমি। পুরো আলোচনা প্রক্রিয়ায় কেউই বলেনি বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা। সুতরাং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় যাত্রাটা যদি ভুল হয় তাহলে এটা সবার সম্মিলিত ভুল। অথচ কেউ কেউ এখন এমনভাবে কথা বলছেন যেন তাকে জাতির পিতা না বানানো পর্যন্ত থামবে না।
আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভিন্ন মতের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এই স্বাধীন দেশে প্রথম গুম করা হয়েছে একজন সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে। সর্বহারা পার্টির কমরেড সিরাজ সিকদারকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাÐ ঘটায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ডিএনএর মধ্যেই রয়েছে ফ্যাসিজম।
জুলাই বিপ্লবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা ঠিক জানি না আসলে কতজন মানুষ মারা গেছে, যদিও আমরা বলছি ১ হাজার। গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ভ‚মিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, এরা কি পুলিশ ছিল? এরা কি বাংলাদেশী মানুষ? অথচ আমার মতো একজন লোক যার একটা পরিবার রয়েছে, বয়স বেড়েছে; আগস্টের দিকে সেই লোকটারও মনে হলো মরে গেলেও সমস্যা নেই, রেডি আছি। তখন শহীদ মিনারের এক প্রোগ্রামে বলেছি মৃত্যু পর্যন্ত তোমাদের সাথে আছি। এভাবে আমাদের মতো অনেক বয়স্ক লোক শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন।
গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় আসন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জটা আসলে অনেক বড়। গত ১৬ বছরে এই রাষ্ট্রকে এতই চূর্ণবিচূর্ণ করে গেছে যে, শুধু সে সর্বশক্তিমান হওয়ার ইচ্ছেটাই যেন বাকি ছিল।তাই বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রকে সংস্কার করা একটু কঠিন হয়ে গেছে।
প্রফেসর আসিফ নজরুল বলেন, আপনারা আমাদের সমালোচনা করবেন কিন্তু একটুখানি ভালোবাসা নিয়ে বলবেন। কারণ আমরা তো আর আওয়ামী লীগ না। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেমন হবে সে বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ন্যূনতম গণতন্ত্র হলো অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন। আরেকটা হচ্ছে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র। যেখানে জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন হবে। আর এই আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছে তারা এই উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছে। এটা যদি আমরা চাই তাহলে আমাদের কিছু সংস্কার করতে হবে।
সংবিধান সংশোধন কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. আলী রিয়াজ বলেন, গণতন্ত্র আমরা চাই জন্মসূত্রে যেসব অধিকার আমরা পাই সেসব রক্ষা করার জন্য। একটা স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরনের প্রথম পথ প্রাতিষ্ঠানিক। সেই প্রতিষ্ঠান তৈরি করাটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। একমাত্র প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রের পথে এগুতে পারব। একব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এই বাংলাদেশে সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। গণতন্ত্র ঐক্যমত না, বরং গণতন্ত্র হলো বহুমত তৈরি করার পথ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, আমরা একটা চ্যালেঞ্জের ভিতরে অলরেডি ঢুকে পড়েছি। আমাদের ফ্যান্টাসিতে কোথাও কোথাও এমন চিন্তা থাকে যা আসলে প্রাগমেটিকস (বাস্তবিক) না। তিনি বলেন, এই যে আমাদের দেশে যা হলো আমি এটাকে বিপ্লব বলতে চাই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিপ্লব পছন্দও করি না। কারণ বিপ্লব বিপ্লব কোনোদিন সাফল্য আনতে পারে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিপ্লব খুব একটা ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি। আমাদের এখন এমন কিছু করা যাবে না, যা আরো বেশি সংকট তৈরি করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিটিজেন সাংবাদিক সাইয়েদ আবদুল্লাহ বলেন, মানুষ এখন নিজেকে প্রজা না ভেবে দেশের নাগরিক ভাবতে শুরু করেছে। এটাই অনেক বড় পরিবর্তন। আমাদের সামনে এখন ১ নাম্বার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অপকর্মকারীদের বিচার করা। আমি মনে করি যে প্রক্রিয়ায় তা করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। সুতরাং সবার আগে বিচার বিভাগের সংস্কার প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশকে যদি ঠিক করতে হয় তাহলে সবার আগে নজর দিতে হবে সচিবালয়ের দিকে। কারণ রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় সেখান থেকে। সচিবালয়কে নাগরিক বান্ধব করতে হবে। পুলিশ বিভাগের আমুল সংস্কার প্রয়োজন। গণমাধ্যমে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা রয়ে গেছে। সুতরাং এই সেক্টরেরও সংস্কার করতে হবে ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কমন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
সভায় আরো বক্তব্য রাখেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, সাংবাদিক সাহেদ আলম, মনির হায়দার, তাসনিম খলিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, কমিটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম।