বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা, সে ঢাকাই গিলে খাচ্ছে নদীটাকে। দখল-দূষণে এ নদীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দুপাড়ে নেই কোনো সবুজের ছিটেফোঁটাও। ক্রমাগত পলিথিন, শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যাল, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল, মবিল, ওয়াসার পয়ঃবর্জ্যসহ গৃহস্থালির বর্জ্যের প্রকোপে পানি হয়েছে নিকষ কালো। বুড়িগঙ্গার পানি দেখলে প্রশ্ন জাগে—এটা নদী, নাকি বর্জ্যের ভাগাড়? নদী বাঁচাতে সরকারের তোড়জোড়ের শেষ নেই। তারপরও সংকট কাটছে না নদীর। কেন নদীকে বাঁচাতে চেয়েও পারছে না সরকার— এ প্রশ্ন পরিবেশপ্রেমী ও নদী পাড়ের মানুষের।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বুড়িগঙ্গা নদী অত সহজে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। নদীর নিচে ৩ থেকে ৪ আস্তরের পলিথিন পড়ে আছে। এ কারণে সেখানে ড্রেজিং করা সম্ভব না। তাই আমাদের সবার উচিত পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা। বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্তকরণের ওপর জোর দিলেও বাস্তবিকভাবে শীতলক্ষ্যাকে টার্গেট করলে ভালো। ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলোর মধ্যে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে শীতলক্ষ্যার ওপর। নদীটি আগামী প্রজন্মের কাছে দূষণমুক্ত হিসেবে হিসেবে পরিচিতি পাবে। পাশাপাশি প্রতি জেলায় একটি করে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করা হবে।
বুড়িগঙ্গা নদীর দুপাড় ঘুরে জানা যায়, এক সময় যে নদী মাছে ভরপুর ছিল, এখন সেখানে শুধু বিষাক্ত কালো পানি আর দূষিত পানির খেলা চলে প্রতিনিয়ত। আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না নদী দূষণ। নদী দূষণের ফলে এই বৃহত্তর নগরীর মানুষের দুঃখ, কষ্টের শেষ নেই। রাজধানী প্রায় ২ কোটি মানুষের পয়ঃবর্জ্য, কলকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য মিশছে এ নদীতে। যার ৪০ ভাগই সরাসরি মিশছে নদীর পানিতে। যে কারণে বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেন প্রায় শূন্যের কোটায়।পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে বুড়িগঙ্গা পার হওয়া জনতা বিড়ম্বনা পোহান। বুড়িগঙ্গায় জীবিকা নির্বাহের তাগিদে খেঁটে খাওয়া মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সকলেই ভোগান্তি পোহাচ্ছে।
দুর্গন্ধে নাক ভারী হয়ে আসলেও করার কিছুই থাকে না। দুর্গন্ধ মেনে নিয়েই তাই জীবন যুদ্ধ চালাতে হচ্ছে নদী পারাপারের যাত্রী সাধারণ ও বুড়িগঙ্গার পাড়ের জনসাধারণের।
এদিকে গবেষণায় মিলেছে ভায়াবহ চিত্র। প্রতি লিটার পানিতে মিলছে ৫ থেকে ৪৫ পিস মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব। পানিতে আর্সেনিকের আদর্শ মাত্রা ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে হলেও বুড়িগঙ্গায় মিলেছে ৫৮ থেকে ৯৮.৪৪ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। ভয়াবহ ক্ষতিকর লেড ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে আদর্শ হলেও এখানে মিলেছে ৫০.১২ থেকে ৬৬.৫৪ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। ক্রোমিয়াম আদর্শ মাত্রা ৫ মিলিগ্রাম হলেও বুড়িগঙ্গায় মিলেছে ৭০.১৫ থেকে ১২০.৮৬ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। ক্যাডমিয়াম আদর্শ মাত্রা ৩ মিলিগ্রাম হলেও বুড়িগঙ্গায় মিলেছে ৮.০২ থেকে ১১.৮৯ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে হলেও এখন তা নেমেছে .০২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে, যার কারণে এ নদীতে প্রাণের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন।
নদীপাড়ের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, এই নদীতে ছোডবেলায় কত সাঁতার যে কাটসি হিসাব নাই। সারাদিন নদীর পানিতেই থাকতাম। মাঝেমধ্যে দলবল নিইয়্যা বড়শি লইয়্যা মাছ ধরতাম। কেউ বেড়াইতে আইলে আমাদের লগে মাছ ধরতো। মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক আগের কথা। আমার বয়স ১৩ বা ১৪ হইবো। তহন কী সুন্দর পানি ছিল এইহানে। দুই-তিন হাত উঁচু উঁচু ঢেউও ছিল। নদীতে মাছ আর মাছ। বড়শি দিয়া কত মাছ ধরসি। সারাদিন নদীতে ঝাঁপাঝাপি কইরা চোখ লাল হইয়া যাইতো। আমি থাকতাম নদীর অই পারে, কেরানীগঞ্জে।
আগানগর- বাদামতলি ঘাটের মাঝি রমিজ উদ্দিন বলেন, যখন মাঝি হিসেবে কাজ শুরু করি তখন নদী পার হতে লাগতো আট আনা। বর্তমানে জনপ্রতি ১০ টাকা করেই পান। কিন্তু তার নিকট এখনো সেই আট আনার দিনই অপেক্ষাকৃত মধুর। আরও বলেন, কেরানীগঞ্জ, কালিগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় রাত হলেই শুরু হতো শিয়ালের হাঁকডাক। এমনকি ২০ বছর আগেও নদীর দুধারে অবাধ আনাগোনা ছিলো শিয়ালের। সে সময় নদীতে বইতো নির্মল শীতল বাতাস। সে বাতাসে পাল তোলা নৌকা বাইতেন মাঝিরা। শীতের দিনে যে চর জাগতো নদীর দুপাশে, তা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল আরও একটি পেশার। চরের মাটি উর্বর ছিল বলে কেউ কেউ শুরু করেন সবজির চাষ। বেশ ফলনও হতো তাতে। নানা রকম সবজিতে ভরে যেতো নদীর দুপাশ। পরিপক্ক হতেই তা বাজারে আনা হতো বিক্রির উদ্দেশ্যে। এখন সে পেশাও বিলুপ্ত। এদের কেউ কেউ এখন করেন মালামাল বহনের কাজ। আবার কেউ কেউ মুদির দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন কোনোভাবে। বর্তমানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এই নদীতে। নেই আগের সেই জৌলুশও। শখের বশেও কেউ আর বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ভীড় করে না। নদীর বুকে চর জাগে না বলে কাশফুলের দেখা নেই দীর্ঘবছর। গাছপালার কোনো চিহ্ন নেই। বুড়িগঙ্গা এখন কেবলই এক দূষিত নদী। যে নদীর জল পান করে জীবন ধারণ করতো হাজার হাজার মানুষ, সে পানিই সবচেয়ে বিষাক্ত আজ। একটা সময় ঢাকার মানুষ হয়তো বলবে, নগরায়ন এবং আধুনিকায়নে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার এই বুড়িগঙ্গাই। জিনজিরার স্থানীয় বাসিন্দা সাহিদুল হক, ওমর ফারুক, দিদার হোসেনসহ কয়েকজন জানান, মানুষ যেমন হৃৎপিণ্ড না থাকলে বাঁচে না, তেমনি নদী না থাকলে ঢাকাও বাঁচানো সম্ভব নয়। যেভাবে বুড়িগঙ্গা নদী মরছে, আর যেভাবে কাঁদছে, তাতে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এ ঢাকা। নদী রক্ষা করতে না পারলে স্বাভাবিক জীবন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ও নদী গবেষক মীর মোহাম্মদ খান বলেন, বুড়িগঙ্গার পানি অবশ্যই বিষাক্ত। সেটা তো স্বাভাবিকভাবে দেখলেই বুঝা যায়। আর এই নদীতে মাছ থাকলেও সেটা খেলে বিভিন্ন রোগ হতো। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা তদারকি সংস্থা কেউই বুড়িগঙ্গার এমন পরিণতির জন্য দায় এড়াতে পারবে না। তবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দিয়ে লাইফসাপোর্ট থেকে এ নদীকে বাঁচিয়ে তোলার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি বলে জানান এই নদী গবেষক ও পরিবেশবিদ।