হাসিনা পদত্যাগ করে থাকলে দেশ ছাড়ার অনুমতি দেন কে?

ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থানের ডিপ্লোম্যাটিক ভিসার মেয়াদের ৪৫ দিন শুক্রবার শেষ হয়ে গিয়েছে। ভিসার মেয়াদ শেষেও তিনি যে ভারতে থাকবেন বেসরকারি তা আগেই স্পষ্ট করেছিল দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রক। হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তে সব দল সায় দিয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। হাসিনার বিস্ফোরক দাবি নিয়ে এখনও রা কাড়ছে না বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। হাসিনার একটি টেলিফোন কথোপকথন গত সপ্তাহে ফাঁস হয়েছে। তাতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি পদত্যাগ করিনি। বিশেষ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা আধিকারিকদের পরামর্শে আমি দেশ ছেড়েছি। আমিই এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’ বাংলাদেশে দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অনেকেই সরকারের জবাব দাবি করেছেন, শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগের অনুমতি কে দিয়েছিল?

হাসিনা এর আগে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতে বসে দুটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশে নৈরাজ্য চলছে। আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চলছে।’

হাসিনার ওই মন্তব্যে তেলেবগুনে জ্বলে উঠেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস। একটি ভারতীয় নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হুঁশিয়ারির সুরে বলেছিলেন, ‘ভারতে থাকাকালে হাসিনাকে মুখ বন্ধ রাখতে হবে। তিনি বিদেশে বসে দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছেন।’

আশ্চর্যের বিষয় হল, হাসিনার নিজেকে এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করা এবং পদত্যাগ না করার দাবি নিয়ে ইউনুস-সহ গোটা সরকার মুখে কুলুপ এঁটে আছে। আওয়ামী লিগের তরফে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে থাকলে তাঁর পদত্যাগপত্র সরকার প্রকাশ করুক। দু’দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পদত্যাগপত্রে কপি ছড়িয়ে পড়লেও সেটি সরকারের তরফে প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়নি। অন্যদিকে, আওয়ামী লিগও বলেছে, ওই পদত্যাগপত্র ফেক।

হাসিনার দাবি নিয়ে এখন নুতন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাঁকে দিল্লিতে পৌঁছে দেওয়া বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমানের বিস্তারিত ফাঁস হওয়ার পর। সরকারের একাংশ দাবি করছিল, তাড়াহুড়োর মধ্যে হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেছেন। যদিও তাঁকে বহনকারী বিমানটির উড়ানের খুঁটিনাটি থেকে জানা যাচ্ছে, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর আবাস গণভবন যখন ছাত্র-জনতার দখলে তখনও হাসিনা ও তাঁর বোন ঢাকায় ছিলেন। বেলা ৩’টে ১১ মিনিটে তাঁর বিমান ঢাকা থেকে নয়া দিল্লির উদ্দেশে রওনা হয়।

প্রশ্ন উঠেছে, হাসিনা যদি পদত্যাগ করেই থাকেন তাহলে তাঁকে দেশ ছাড়ার অনুমতি কে দিল? তিনি পদত্যাগ করে থাকলে প্রশাসনের আর তাঁর নির্দেশ শোনার কথা নয়। তাহলে কার নির্দেশে বিমান বাহিনীর বিমান তাঁকে ভারতে পৌঁছে দিয়েছিল।

৫ অগাস্ট হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে ৮ অগাস্ট রাত ৮’টা পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনও সরকার ছিল না। সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর সরকারিভাবে তিনিই প্রথম দেশবাসীকে জানান বাংলাদেশ টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে।

সেই তিনি সম্প্রতি একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর আমার জানা ছিল না। দেশের অস্থির পরিস্থিতি নিয়ে আমি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে সেনা নিবাসে বৈঠক করছিলাম। আমাকে বৈঠকের মাঝে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে গিয়েছেন। প্রশ্ন হল, সেনা প্রধানকে অন্ধকারে রেখে প্রধানমন্ত্রী বা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অমন অস্থির পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়া সম্ভব ছিল কি?

প্রশ্ন হল, পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সেনা প্রশাসন মানতে বাধ্য নয়। তাহলে হাসিনাকে বিমান বাহিনীর বিমানে দেশ ছাড়ার অনুমতি কে দিয়েছিল? অনেকেই মনে করছেন হাসিনা আসলেই পদত্যাগ করেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই সেনাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ভারতে পৌঁছে দিতে। সেনা সেই নির্দেশ পালন করে।

বাংলাদেশ প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল, হাসিনা ঢাকা থেকে প্রথমে সেনা হেলিকপ্টারে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় যান। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি মালবাহী বিমানে তিনি দিল্লি রওনা হন।

কিন্তু হাসিনাকে ভারতে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যে বিমান সেটির স্কোয়াক কোড (যা উড়ানের আগে প্রতিটি বিমানের জন্য বরাদ্দ হয়) এজিএএস ১৪৩১-এর ফ্লাইট ডিটেলস রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে, সেটি ঢাকা থেকে সরাসরি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয় বিকাল ৩’টা ১১ মিনিটে।

জানা যাচ্ছে ঢাকার একটি সেনা বিমান বন্দর থেকে তাঁর ফ্লাইটটি ওড়ে। ততক্ষণে গণভবনে লুটতরাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। মিডিয়াতেও খবর হয়ে যায়, হাসিনা পালিয়েছেন। কিন্তু বিমানের রিপোর্ট বলছে, তিনি দেশ থেকে পালিয়েছেন বলে খবর হওয়ার পর আরও অন্তত দু-আড়াই ঘণ্টা ঢাকাতেই ছিলেন। হেলিকপ্টার তাঁকে গণভবন থেকে সেনা বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল।

প্রশাসনিক মহলের বক্তব্য, সেনা বিমানের দেশের সীমা অতিক্রম করে পড়শি দেশে যেতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি লাগে। হাসিনার দেশত্যাগ এবং তাঁকে বিমানে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি কে দিয়েছিলেন? সেনা প্রধান জানিয়েছেন, তিনি এই বিষয়ে অবগত ছিলেন না। প্রশাসনিক মহলের বক্তব্য, বিমান বাহিনীর প্রধান এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কারণ আর্মি চিফ ওয়াকার-উজ-জামান বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান। সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি। যদিও রাষ্ট্রপতির ওই মর্যাদা আলঙ্কারিক। তাঁর পক্ষে হাসিনাকে দেশত্যাগের অনুমতি দেওয়া সম্ভব ছিল না।

জানা যাচ্ছে, হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমায় থাকাকালে সেটির ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করা ছিল। এই যন্ত্র অফ করা থাকলে বিমানকে আকাশে লোকেট করা যায় না। শুধু এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। পাইলটের এই সিদ্ধান্ত থেকে ধারণা করা হচ্ছে, দেশের ভূখণ্ডে হাসিনার বিমান নিরাপদ বোধ করেনি। মনে করা হচ্ছে, হাসিনাকে বহনকারী বিমানটির নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

নিরাপত্তার দিকটি আরও স্পষ্ট হয়েছে বিমানটির দিল্লি যাওয়ার রুট থেকে। ঢাকা থেকে সরাসরি দিল্লিগামী বিমানগুলি ওড়ার পর বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তের শহর রাজশাহীর আকাশ ছুঁয়ে পশ্চিমবঙ্গের মালদহের উপর দিয়ে দিল্লির দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু ৫ অগাস্ট হাসিনার বিমান কলকাতার উপর দিয়ে উড়েছিল। এরফলে বাংলাদেশের আকাশসীমা অতিক্রম করতে বিমানটির পনেরো মিনিট সময় কম লাগে। মনে করা হচ্ছে হাসিনা দ্রুত দেশের আকাশসীমা অতিক্রম করে ভারতের সীমানায় ঢুকে পড়তে চেয়েছিলেন।

Leave a Comment